পূজা-পার্বণ ও ধর্মাচার

নবম শ্রেণি (মাধ্যমিক ২০২৪) - হিন্দুধর্ম শিক্ষা - দ্বিতীয় অধ্যায় | | NCTB BOOK
4

আমরা সকলেই হিন্দুধর্মের বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান যেমন বিয়ে, মুখেভাত, হাতেখড়ি ইত্যাদিতে অংশগ্রহণ করেছি। দুর্গাপূজা, কালীপূজা, সরস্বতীপূজা ইত্যাদিতেও অংশ নিয়েছি। এমনকি বাড়িতে বা পাড়ার এসব পূজার আয়োজনে সাহায্যকারী হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা আমাদের অনেকেরই আছে।

  • তুমি অংশগ্রহণ করেছ বা তোমার দেখা হিন্দুধর্মের এ রকম একটি অনুষ্ঠান সম্পর্কে লেখো।

 

ছক ২.১: আমার দেখা ধর্মানুষ্ঠান

 

 

হিন্দুধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলো নানা নিয়ম-কানুন মেনে অনুষ্ঠিত হয়। অভিভাবক/ধর্মীয় অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে আলোচনা করে যে কোনো একটি অনুষ্ঠান/পূজা/পার্বণের প্রয়োজনীয় উপকরণ, নিয়ম-কানুনের তালিকা করো।

 

ছক ২.২: অনুষ্ঠান-বিধি

অনুষ্ঠান/পূজা/ পার্বণের নাম ও উদ্দেশ্য:

 

 

 

 

 

 

 

 

প্রয়োজনীয় উপকরণ:

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

নিয়ম কানুন:

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

এই যে বিভিন্ন ধরনের পূজা-পার্বণ, অনুষ্ঠানের ভিন্ন ভিন্ন ধরনের নিয়ম এবং সে মোতাবেক বিভিন্ন পূজায় বিভিন্ন ধরনের উপকরণ ব্যবহৃত হয়, এগুলোকে বলা হয় পূজার উপচার।

পূজা বলতে বোঝায় প্রশংসা বা শ্রদ্ধা নিবেদন করা। দেশ ও অঞ্চলভেদে পূজাপদ্ধতির ভিন্নতা লক্ষ করা যায়। তবে পূজার মৌলিক নিয়ম ও উপচারগুলোর মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। দেব-দেবী অনুসারে পূজার পদ্ধতি ও মন্ত্র ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। পূজা করার সময় যেসব নিয়ম-নীতি অনুসরণ করা হয়, সেগুলো পূজাবিধি নামে পরিচিত।

বৈদিক যুগে পূজা ছিল যজ্ঞভিত্তিক। এরপরে পৌরাণিক যুগে ঈশ্বরের বিভিন্ন শক্তির সাকার রূপ হিসেবে দেবদেবীর পূজা করা হতো। ঋষিরা ধ্যানে দেবতার রূপ প্রত্যক্ষ করে বর্ণনা করেছেন। বহু দেবদেবীর পূজার প্রচলন থাকলেও হিন্দুধর্ম কিন্তু বহু ঈশ্বরবাদী নয়। দেবতারা ঈশ্বর নন। তাঁরা হলেন ঈশ্বরের ভিন্ন ভিন্ন ক্ষমতার সাকার রূপের প্রকাশ মাত্র। ঈশ্বর ও দেবতার রূপকে চিন্তা করে ঘট, প্রতিমা, যজ্ঞের বেদী, আগুন, জল, যন্ত্র (বিশেষ প্রতীকী চিহ্ন), প্রতিমার ছবি, মণ্ডল এবং হৃদয়ে পূজা করার প্রচলন রয়েছে। বর্তমানে প্রতিমা, ছবি, ঘট প্রভৃতি আধারে পূজা করার রীতিই বেশি প্রচলিত।

 

পূজার উপচার বা উপকরণ

 

ফুল, দূর্বা, বেলপাতা, তুলসীপাতা, চন্দন, আতপ চাল, ধূপ, দীপ ও নৈবেদ্য ইত্যাদি পূজার উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সাধারণত পঞ্চ বা দশ উপচারে দেবতার পূজা করা হয়। তবে বিশেষ পূজায় দেবতাকে ষোড়শ উপচারে পূজা করা হয়।

 

পঞ্চোপচার- গন্ধ, পুষ্প, ধূপ, দীপ ও নৈবেদ্য এই পাঁচটি হচ্ছে পঞ্চোপচার তথা পূজার প্রধান উপচার বা উপকরণ।

দশোপচার- পাদ্য, অর্ঘ্য, আচমনীয়, স্নানীয়, পুনরাচমনীয়, গন্ধ, পুষ্প (ফুল), ধূপ, দীপ ও নৈবেদ্য এই দশটি হচ্ছে দশোপচার।

 

ষোড়শোপচার- রজতাসন (রূপার আসন), স্বাগত (আবাহন), পাদ্য, অর্ঘ্য, আচমনীয়, মধুপর্ক, স্নানীয়, বস্ত্র, আভরণ, গন্ধ, পুষ্প, ধূপ, দীপ, নৈবেদ্য, পুনরাচমনীয় ও তাম্বুল (পান) এই ষোলোটি উপচার হচ্ছে ষোড়শোপচার। ষোড়শ উপচারে পূজার অন্যতম উপকরণ হচ্ছে মধুপর্ক। এই মধুপর্ক দুধ, দই, ঘি, মধু, চিনি এবং সামান্য জলের সংমিশ্রণে তৈরি করা হয়।

 

এক এক দেবতা এক এক প্রকার ফুল ও পাতা বেশি ভালোবাসেন; আবার কোনো কোনো ফুল ও পাতা পছন্দ করেন না। যেমন-শিবপূজায় ধুতরা ও আকন্দ ফুল, নারায়ণ পূজায় সাদা ফুল, দুর্গাপূজায় লাল রঙের ফুল মঙ্গলজনক। বিষ্ণু বা নারায়ণকে অবশ্যই তুলসী পাতা দিয়ে পূজা করতে হয়, শিব বেলপাতা পছন্দ করেন। গণেশ, শিব ও দুর্গার পূজায় তুলসী পাতা নিষিদ্ধ। আবার নারায়ণপূজা ও সূর্যপূজায় বেলপাতা নিষিদ্ধ।

 

পূজার উপকরণের তাৎপর্য

 

পূজার কিছু উপকরণের তাৎপর্য তুলে ধরা হলো

১। বিগ্রহ বা প্রতিমা: প্রতিমার রূপের মাঝে নিবিড়ভাবে মগ্ন হলে ভক্ত পরমাত্মার সাক্ষাৎ লাভ করে। 

২। কলস বা ঘট: পূজায় মাটি বা ধাতুর তৈরি কলস বা ঘট ব্যবহার করা হয়। কলস বা ঘট মঙ্গলের প্রতীক। এই ঘট পৃথিবী বা মানবদেহ নির্দেশ করে। ঘটের জল প্রাণ তথা কুলকুন্ডলিনী বা পবিত্র গঙ্গার প্রতীক। কলসের মুখে আম্রপল্লব বিকাশমান প্রগতিকে নির্দেশ করে। ঘটের নারিকেল জ্ঞান তথা মস্তকের প্রতিনিধিত্ব - করে। কলসের চওড়া অংশ পৃথিবীকে বোঝায়। কলসের ঘাড় অগ্নিকে এবং মুখের খোলা অংশ প্রাণরূপ বায়ুকে নির্দেশ করে। ঘটের উপর দূর্বা, চাল ও নৈবেদ্য জীবজগতের আহারের প্রতীক। ঘটের বহমান জল সংগীত তথা জীবজগতের সঙ্গে সৃষ্টিশীল সুরের সম্পর্ক প্রকাশ করে।

 

৩। প্রদীপ: প্রদীপের আলো জ্ঞানের প্রতীক। 

৪। শঙ্খ: শঙ্খ মঙ্গলসূচক পবিত্র ধ্বনির সৃষ্টি করে। জ্ঞান ও ভক্তির জগতে আহ্বান জানায়। 

৫। ফুলের মালা: ফুলের মালা সম্মান ও সজ্জিত করার মাঙ্গলিক উপকরণ। 

৬। আসন: আসন দেবতাদের বসার জন্য ব্যবহার করা হয়। 

৭। মুকুট: মুকুট উচ্চ সম্মানের প্রতীক। 

৮। পান-সুপারি: পান শুদ্ধতার প্রতীক। সুপারির কঠিন অংশ আমাদের অহংবোধের প্রতীক, যা পূজার শেষে ইষ্ট দেবতার উদ্দেশে নিবেদন করা হয়। 

৯। কপূর: সুগন্ধি কপূর বিশুদ্ধতা ও স্নিগ্ধতার প্রতীক। 

১০। গঙ্গাজল: গঙ্গার জল পবিত্রতার প্রতীক। এই জল বিভিন্ন ধরনের রোগ নিরাময় করে বলে বিশ্বাস করা হয় । এই জলকে আধ্যাত্মিক চিন্তা-চেতনা ও বৈষয়িক সম্পদ বৃদ্ধিতে সহায়ক বলে গণ্য করা হয়। 

১১। থালা: থালা সমস্ত উপকরণের সমাহারের প্রতীক। 

১২। ধূপ: ধূপ সুগন্ধ তথা ভালো কাজের প্রতীক, যা খারাপ শক্তির প্রভাব থেকে জগৎকে মুক্ত রাখে। 

১৩। চন্দন: চন্দন কাঠের গন্ধ পবিত্র পরিবেশ সৃষ্টি করে। 

১৪। আবির: আবির রোগ নিরাময়ক ও সৌহার্দ্যের প্রতীক। তাই দোলযাত্রা বা হোলি উৎসবে এবং বিভিন্ন পূজায় এই উপকরণের ব্যবহার হয়। 

১৫। চাল: চাল বস্তুগত আহারের প্রতীক, যা প্রাণরূপ শরীরকে জীবন ধারণের জন্য টিকিয়ে রাখে। 

১৬। নৈবেদ্য: ফুল, ফল, মিষ্টি জাতীয় খাদ্য ইত্যাদি নৈবেদ্য হিসেবে প্রদান করা হয়, যা আত্মসমর্পণের নির্দেশক। 

১৭। পঞ্চারতি: পঞ্চভূতকে পরমাত্মার সঙ্গে একাত্ম হওয়ার অনন্য মাধ্যম পঞ্চারতি। 

১৮। ঘণ্টা: ঘণ্টা মঙ্গলজনক শব্দসৃষ্টির প্রতীক। 

১৯। হলুদ: হলুদ পরিশুদ্ধ চিন্তার নির্দেশক ও মনের আকর্ষক। হলুদে ভেষজ গুণ রয়েছে। হলুদ দেবী দুর্গাকেও (বাসন্তী দেবী) নির্দেশ করে। 

২০। পবিত্র সুতা: পবিত্র সুতা বন্ধনের প্রতীক। তাই ঘটবন্ধনের সময় কাণ্ডারের চারপাশে সুতা ব্যবহার হয়

 

  • তোমার পছন্দমতো পূজার উপকরণের নাম, প্রধান বৈশিষ্ট্য এবং এগুলোর তাৎপর্য কীভাবে তোমার বাস্তব জীবনে ইতিবাচক প্রভাব রাখতে পারে তার তালিকা করো। তোমার সুবিধার জন্য একটি করে দেওয়া হলো।

 

ছক ২.৪: পূজার উপকরণ

উপকরণ

বৈশিষ্ট্য

ইতিবাচক প্রভাব

প্রদীপ

জ্ঞানের আলো

অজ্ঞানতা দূর করে দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রসারিত করা।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

পূজার বাদ্যযন্ত্র

দেবদেবীর পূজায় কাঁসা, ঘণ্টা, ঢাক, ঢোল, সানাই প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র বাজানো হয়। ঘণ্টাকে বলা হয় 'সর্ববাদ্যময়ী'। অন্য বাদ্যের অভাবে শুধু ঘণ্টা বাজিয়েও পূজা করা যায়। তবে এক এক দেবতার পূজায় এক এক বাদ্য নিষিদ্ধ। যেমন-লক্ষ্মীপূজায় ঘণ্টা, শিবপূজায় করতাল, দুর্গাপূজায় বাঁশি, ব্রহ্মাপূজায় ঢাক এবং সূর্যপূজায় শঙ্খ বাজানো নিষেধ।

পূজার আরতি

বাম হাতে ঘণ্টা বাজাতে বাজাতে মূলমন্ত্র অথবা স্তোত্রপাঠ করতে হয়। একইসঙ্গে দেবতার শ্রীচরণে চার বার, নিজের নাভিদেশে দুই বার, মুখমণ্ডলে তিন বার ও সর্বাঙ্গে সাত বার ঘুরিয়ে পঞ্চারতি যথাক্রমে- দীপ, কপ্রদীপ, ধূপ, জলপূর্ণ শঙ্খ, বস্ত্র, ফুল ও চামর দিয়ে আরতি করে প্রণাম করতে হয়। এছাড়া ময়ূর-পালকের পাখা ব্যবহারের প্রচলন আছে।

ইতঃপূর্বে আমরা বেশ কয়েকটি দেবদেবীর পূজাপদ্ধতি জেনেছি। এবার আমরা কালীপূজা এবং শ্রীকৃষ্ণের জন্মাষ্টমী সম্পর্কে জানব।

 

 

 

 

কালীপূজা

'কালী' শব্দটি 'কাল' শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ। 'কাল' শব্দের অর্থ 'কৃষ্ণ' বা 'ঘোর বর্ণ'। প্রকৃত অর্থে কাল বা সময়কে রচনা করেন যিনি তিনিই কালী। দেবী কালী মা দুর্গারই একটি রূপ। শাক্ত মতে তিনিই পরম ব্রহ্ম। কালী শবরূপী শিবের উপর দন্ডায়মান। শিব হচ্ছেন স্থির বা নীরব। আর কালী হচ্ছেন 'গতির প্রতীক'। এই গতিই জগতের প্রাণ। হিন্দুধর্মে সুদূর অতীতকাল থেকে মাতৃপূজার প্রচলন রয়েছে, যার মধ্যে কালীপূজা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

আবার, কালীমাতার গায়ের বর্ণ কালো- এই দৃষ্টিতে তাঁকে কালী বলা হয়। অসুর বিনাশের জন্য তিনি রুদ্রময়ী কৃষ্ণমূর্তি ধারণ করেছিলেন। তখন তাঁর নাম হয় কালীদেবী। এ বিষয়ে একটি কাহিনি রয়েছে:

পুরাকালে শুম্ভ ও নিশুম্ভ নামে দুই অত্যাচারী অসুর ছিল। এরা ছিল দুই ভাই, যাদের অত্যাচারে দেবতারা পর্যন্ত অতিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। একসময় এদের সাথে দেবতাদের যুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধে দেবতারা পরাজিত হয়ে স্বর্গরাজ্য থেকে বিতাড়িত হন। দেবতারা তখন দেবরাজ ইন্দ্রের নেতৃত্বে দেবী মহামায়ার শরণাপন্ন হন। বিবরণ শুনে ক্রুদ্ধ দেবীর শরীর-কোষ হতে কৌশিকী নামে এক দেবীর জন্ম হয়। দেবী মহামায়াও কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করেন। মহামায়ার সেই কৃষ্ণমূর্তিই কালী। অসুরদের সেনাপতি চন্ড ও মুন্ড দেবীকে আক্রমণ করে। দেবী পূর্বের ভয়ঙ্কর কৃষ্ণমূর্তি অর্থাৎ কালীরূপ ধারণ করেন। তাঁর হাতে চণ্ড-মুণ্ড নিহত হয়। দেবীর নাম হয় চামুণ্ডা। সবশেষে আসে শুম্ভ ও নিশুম্ভ। দেবীর হাতে শুম্ভ-নিশুম্ভসহ একে একে সকল অসুর নিহত হয়। অসুরবিনাশী কৃষ্ণবর্ণের সেই দেবীই কালীমাতা হিসেবে পূজিত।

 

কালীমূর্তির তাৎপর্য

 

কালীমাতার মূর্তির বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। দেবীর চার হাত। উপরের ডান হাতে অভয়মুদ্রা ধারণ করা, বাম হাতে খা। নিচের ডান হাতে বরমূদ্রা, বাম হাতে ছিন্ন মস্তক। দেবীর কন্ঠে মুন্ডমালা। মুন্ড বা মস্তকে চোখ, কান, নাক, জিহ্বা ও ত্বক- এই পাঁচটি ইন্দ্রিয় রয়েছে, যা সকল জ্ঞানকে প্রকাশ করে। দেবীর কোমরে কাটা হাতের মেখলা, যা কর্মের ধারক। তিনি সাদা দাঁত দিয়ে লাল বর্ণের জিহ্বাকে কর্তন করে আছেন। এটি সত্ত্বগুণ দিয়ে রজোগুণকে খণ্ডন করা বোঝায়, অর্থাৎ ত্যাগের দ্বারা ভোগকে জয় করা বোঝায়। দেবীর শ্মশান-বাস কর্মফল ভোগান্তে জীবের শেষ আশ্রয়স্থলকে নির্দেশ করে। তাঁর তিনটি চোখ- মানস, জ্ঞান ও দিব্য। শ্মশানবাসী, সর্বত্যাগী দেবীর পায়ের কাছে মহাকাল শিব শুয়ে আছেন। অসুর বিনাশের শেষে তাণ্ডবনৃত্যরত দেবীকে শান্ত করার জন্য স্বামী মহাকাল বা শিবের এই অবস্থানকে দেখানো হয়েছে। তাছাড়া জগৎপ্রসবিনী হিসেবে সমস্ত লজ্জার উর্ধ্বে উঠে দেবী বসন ত্যাগ করে দিগম্বরা হয়েছেন।

 

কালীপূজার সময়

 

কালীপূজা দুভাবে হয়- গৃহে এবং সর্বজনীন মন্দিরে। কার্তিক মাসের অমাবস্যা তিথিতে কালীপূজা হয় যা সর্বাধিক প্রচলিত পূজা। এছাড়া মাঘ মাসের কৃষ্ণা চতুর্দশী তিথিতে রটন্তী এবং জ্যৈষ্ঠ মাসের অমাবস্যা তিথিতে ফলহারিণী কালীপূজাও যথেষ্ট জনপ্রিয়। এছাড়া কালীমাতার মন্দিরে নিত্যপূজাও অনুষ্ঠিত হয়।

 

কালীপূজা পদ্ধতি

 

বাড়িতে বা মণ্ডপে প্রতিমা তৈরি করে কালীপূজা করা হয়। গভীর রাতে কালী পূজা করা হয়। দেবীর চক্ষু দান ও প্রাণ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই কালীপূজা শুরু হয়। ধ্যান, পূজা, আরতি, ভোগ ইত্যাদির পর প্রণাম ও পুষ্পাঞ্জলির মাধ্যমে পূজার সমাপ্তি হয়।

 

কালীপূজার ধ্যান

 

শবারূঢ়াং মহাভীমাং ঘোর-দংষ্ট্রাবরপ্রদাম্

হাস্যযুক্তাং ত্রিনেত্রাঞ্চ কপালকর্তৃকাকরাম্।

মুক্তকেশীং লোলজিহ্বাং পিবন্তীং রুধিরং মুহঃ

চতুর্বাহযুতাং দেবীং বরাভয়করাং স্মরেৎ ।।

 

সরলার্থ: দেবী কালী শবারূঢা, ভীমা ভয়ংকরী, তিনি ত্রিনয়নী, ভয়ানক তাঁর দাঁত, লোল তাঁর জিহ্বা। তিনি মুক্তকেশী, হাতে নরমুণ্ড ও কর্তৃকা (কাটারি)। অপর দুহাতে বর ও অভয় মুদ্রা। দেবী হাস্যময়ী।

 

প্রণামমন্ত্র:

কালি কালি মহাকালি কালিকে পাপনাশিনি।

ধর্মার্থমোক্ষদে দেবি মহাকালি নমোহস্তুতে।।

 

সরলার্থ: হে কালী, মহাকালী, কালিকা পাপনাশিনী, ধর্ম, অর্থ ও মোক্ষদায়িনী দেবী তোমাকে নমস্কার করি।

 

কালীপূজার শিক্ষা ও প্রভাব

 

দেবী কালী বিশ্বের সকল অশুভ শক্তি ধ্বংস করে সকলের মধ্যে মঙ্গলবার্তা ছড়িয়ে দেন। তিনি অন্যায় প্রতিরোধকারিণী ও কল্যাণময়ী। তিনি তাঁর ভক্তদেরকে মাতৃরূপে পালন করেন। তিনি সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠায় নিয়োজিত। তিনি আমাদের সদা মঙ্গল করেন। আমরা তাঁর কাছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিবাদী, আবার সাধারণের প্রতি কোমল হওয়ার শিক্ষা পাই। পাশাপাশি অশুভ শক্তি সন্তানের কোনো ক্ষতি করতে চাইলে মা রুদ্রা চামুণ্ডামূর্তি ধারণ করে সরাসরি তা বিনাশ করেন। তাই কালীমাতার পূজার দ্বারা মায়ের স্নেহের পাশাপাশি অশুভ শক্তির কাছ থেকে আমরা রক্ষা পেতে পারি।

 

পূজা উপলক্ষে মেলা বসে। ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে উৎসবে যোগ দেন। নির্মল আনন্দে মেতে উঠেন। যা একটি সামাজিক বন্ধন সৃষ্টি করে। এটি কালীপূজার একটি বিশেষ তাৎপর্য। এ পূজার মাধ্যমে আমাদের আর্থ-সামাজিক, পারিবারিক ও নৈতিক জীবনে ইতিবাচক প্রভাব পড়ে।

 

  • দেবী কালীর যে বিষয়টি সমাজের জন্য কল্যাণকর বলে তোমার মনে হয় সেটি ব্যাখ্যাসহ লেখো।

ছক ২.৫: কালীপূজার তাৎপর্য

 

 

 

জন্মাষ্টমীর কথা

 

জন্মাষ্টমী হিন্দুদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব। প্রতিবছর ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের রোহিণী নক্ষত্রযুক্ত অষ্টমী তিথিতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জন্মোৎসব উদ্যাপন করা হয়। এই দিন জন্মাষ্টমী ব্রতের সঙ্গে হিন্দুধর্মাবলম্বীরা যথাযোগ্য মযার্দায় জন্মাষ্টমী উদ্যাপন করেন।

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বসুদেব ও দেবকীর অষ্টম সন্তান হিসেবে জন্মগ্রহণ করেন। দেবকীর দাদা কংস তাঁর পিতা উগ্রসেনকে বন্দি করে মথুরার সিংহাসন গ্রহণ করেন। বসুদেব ও দেবকীর বিয়ের পরপরই দৈববাণীর মাধ্যমে কংস জানতে পারল যে, দেবকীর অষ্টম গর্ভের সন্তানের হাতে তার মৃত্যু হবে। এই কথা শুনে কংস দেবকী ও বসুদেবকে কারাগারে বন্দি করে। একে একে তাঁদের ছয় সন্তানকে হত্যা করে কংস। শ্রীহরির নির্দেশে বসুদেব- দেবকীর সপ্তম গর্ভের ভ্রূণ রোহিণী নিজ গর্ভে স্থাপন করেন এবং সন্তান বলরামের জন্ম দেন। তাঁদের অষ্টম সন্তান হিসেবে জন্ম নেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। কৃষ্ণের জন্মরাত্রেই দৈব নির্দেশে কংসের কারাগার থেকে বসুদেব তাঁকে গোকুলে নিয়ে যান। তাঁর নতুন মাতাপিতা হলেন যশোদা ও নন্দ।

 

শৈশবেই শ্রীকৃষ্ণকে মেরে ফেলার জন্য কংস পুতনা, শকটাসুর, কালীয় নাগ, তৃণাবর্ত, বৎসাসুর, বকাসুর, ধেনুকাসুর, অঘাসুর ইত্যাদি রাক্ষসদের পাঠায়। কিন্তু ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাদের প্রত্যেককে বধ করেন।

 

জন্মাষ্টমী ব্রত পালনপদ্ধতি

ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জন্মাষ্টমী ব্রতের আগের দিন সংযম পালন করে হবিষ্যান্ন গ্রহণ করতে হয়। জন্মাষ্টমী ব্রত পূজার দিন ভোরবেলায় স্নান করে উপবাস থাকতে হয়। তিথি অনুসারে রাতে শালগ্রাম শিলা সামনে রেখে নানাবিধ উপচারে বাল্য গোপালরূপী কৃষ্ণের বিগ্রহপূজা করতে হয়। গোপালরূপী বিগ্রহকে একটি ফল বা কুমড়ায় রেখে পূজার আগে কৃষ্ণের ভূমিষ্ঠ হওয়ার প্রতীকী আয়োজন করা হয়। ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর রেশম ও নতুন ছুরি বা ব্লেড দিয়ে নাড়ি কাটার আয়োজন করতে হয়। এরপর ষষ্ঠী দেবীর পূজা করা হয়। তারপর শ্রীকৃষ্ণের নামকরণ, চূড়াকরণ, উপনয়নসহ গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারগুলো যথাযোগ্য মর্যাদায় সম্পাদন করা হয়।

বালকরূপী শ্রীকৃষ্ণের ধ্যান

 

মাঞ্চাপি বালকং সুপ্তং পর্য্যঙ্কে স্তনপাষিণম্।

শ্রীবৎসবক্ষঃপূর্ণাঙ্গং নীলোৎপলদলচ্ছবিম্।

 

সরলার্থ: বালকরূপী শ্রীভগবান পালঙ্কে শুয়ে স্তন পান করছেন, তাঁর বুক অপূর্ব সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ ও শরীর যেন নীলপদ্মের পাঁপড়ির মতো।

 

পূজামন্ত্র 

"ওঁ ক্রীং শ্রীকৃষ্ণায় নমঃ।"

 

ধ্যান ও মন্ত্র উচ্চারণের পর বেদমন্ত্রে আগুন স্থাপন করে ঘি দিয়ে হোম করতে হয়। হোমের মন্ত্র, "ওঁ ধর্মায় ধর্মেশ্বরায় ধর্মপতয়ে ধর্মসম্ভায় গোবিন্দায় নমো নমঃ স্বাহা'। অতঃপর গুড়মেশানো ঘি দিয়ে চন্দ্রার্ঘ্য দিতে হয়। এ সময়ে শঙ্খে জল, কুশ, চন্দন, দূর্বা, আতপ চাল নিয়ে বীরাসনে বসে চন্দ্রকে অর্ঘ্য দিতে হয়। আর মন্ত্র উচ্চারণ করতে হয়, "ক্ষীরোদার্ণবসম্ভূত অত্রিনেত্রসমুদ্ভব। গৃহাণার্ঘ্যং শশাঙ্কেদং রোহিণ্য। ব্রহ্মাত্মে সহিতো মম।"

চন্দ্রের প্রণামমন্ত্র "ওঁ জ্যোৎস্নায়া পতয়ে তুভ্যং জ্যোতিষাং পতয়ে নমঃ। নমস্তে রোহিণীকান্ত সুধাবাস নমোহস্তুতে। নভোমণ্ডল দীপায় শিরোরস্নায় ধূর্জটেঃ। কলাভিবর্দ্ধমানায় নমশ্চন্দ্রায় চারবে।"

 

শ্রীকৃষ্ণের প্রণাম মন্ত্র

 

কৃষ্ণায় বাসুদেবায় হরয়ে পরমাত্মনে। 

প্রণত ক্লেশনাশায় গোবিন্দায় নমো নমঃ।। 

বসুদেবং সুতং দেবং কংসঃ চাণুরমর্দনঃ। 

দেবকী পরমানন্দং কৃষ্ণং বন্দে জগৎগুরোঃ।। 

হে কৃষ্ণ করুণাসিন্ধো দীনবন্ধো জগৎপতে। 

গোপেশ গোপীকাকান্ত রাধাকান্ত নমোহস্তুতে।। 

পাপোহং পাপকর্মাহং পাপাত্মা পাপসম্ভবঃ। 

ত্রাহি মাং পুন্ডরীকাক্ষ সর্বপাপ হরো হরিঃ।।

 

দক্ষিণা, অচ্ছিদ্রাবধারণ করে পূজা শেষ করতে হবে। 

ব্রত সমর্পণ মন্ত্র- "ভূতায় ভূতেশ্বরায় ভূতপতয়ে ভূতসম্ববায় গোবিন্দায় নমো নমঃ" ॥

 

পূজা শেষে প্রসাদ ভোজনের আগে পারণ মন্ত্র উচ্চারণ করতে হয়- "সর্বায় সর্বেশ্বরায় সর্বপতয়ে সর্বসম্ভবায়ে গোবিন্দায় নমো নমঃ।"

 

জন্মাষ্টমীর শিক্ষা ও প্রভাব

 

শ্রীকৃষ্ণের জন্মের সময়ে চারিদিকে অরাজকতা, নিপীড়ন, অত্যাচার চরম পর্যায়ে ছিল। সেই সময়ে মানুষের স্বাধীনতা বলে কিছু ছিল না। সবখানে ছিল অশুভ শক্তির বিস্তার। এই অশুভ শক্তি থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। জন্মাষ্টমীতে আমরা পূজা ও শোভাযাত্রার মাধ্যমে সমবেত হয়ে পারস্পরিক সহমর্মিতা ও একাত্মতার বোধ প্রকাশ করি। তাই আবহমানকালের চিরন্তন ধারায় কৃষ্ণের জন্মাষ্টমী সকলের কাছে একটি চিরন্তন উৎসব।

 

  • তোমার এলাকায় কীভাবে জন্মাষ্টমী উদ্যাপিত হয়, এ উপলক্ষে কী কী আয়োজন হয়- নিজের অভিজ্ঞতা থেকে লেখো। (নিজের যদি মনে না থাকে তাহলে বাড়ির/এলাকার বড়দের সাহায্য নাও।)

 

ছক ২.৬: আমার এলাকায় জন্মাষ্টমী উৎসব

 

সংক্রান্তি

 

সংক্রান্তি অর্থ সঞ্চার বা গমন করা। সূর্যের এক রাশি থেকে অন্য রাশিতে সঞ্চার বা গমন করাকেও তাই সংক্রান্তি বলা হয়। প্রতিটি বাংলা মাসের শেষ দিন অর্থাৎ যেদিন মাসটি পূর্ণ হয় সে দিনকে সংক্রান্তি বলে। এভাবে ১২ মাসে ১২টি সংক্রান্তি আসে। এগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য পৌষসংক্রান্তি ও চৈত্রসংক্রান্তি। শাস্ত্র ও লোকাচার অনুসারে এই দিনে স্নান, দান, ব্রত, উপবাস, পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে তর্পণ প্রভৃতি অত্যন্ত মঙ্গলজনক।

চৈত্রসংক্রান্তির প্রধান উৎসব শিবপূজা বা নীলপূজা। এই পূজার একটি অঙ্গ চড়কপূজা। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এই চৈত্রসংক্রান্তিতে মেলা হয়। এজন্যই সংক্রান্তিময় বারোটি মাসের পূজা ও অনুষ্ঠানের আনন্দকে ১২ মাসে ১৩ পার্বণ বলে বর্ণনা করা হয়।

 

বর্ষবরণ

 

রাজা শশাঙ্কের আমল থেকে বাংলা নববর্ষের সূচনা হলেও মোগল সম্রাট আকবরের সময় থেকে এর আনন্দ আয়োজন আরো বিস্তার লাভ করে বলে মত রয়েছে। তবে বাংলা বর্ষবরণ উৎসব কখন, কীভাবে প্রথম শুরু হয়েছিল, তার দিনক্ষণ নির্দিষ্ট করে বলা কঠিন। প্রাচীনকাল থেকেই গ্রামীণ বাংলাদেশে বৈশাখ মাসের শুরুতে হালখাতা, পুণ্যাহ, আমানি, লাঠিখেলা, কবিগান, ষাঁড়ের লড়াই, বৈশাখী মেলা ইত্যাদি নামে নানা রকম পারিবারিক, সামাজিক উৎসব চালু ছিল।

 

বর্ষবরণের সময়ে হিন্দুরীতি অনুযায়ী কিছু নির্দিষ্ট লোকাচার থাকলেও পহেলা বৈশাখের উৎসবটি ঐতিহ্যগতভাবে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাংলার সকলেই উদ্যাপন করে আসছে। বর্তমানে এটি বাঙালির একটি সর্বজনীন জাতীয় উৎসব। অতীতের সমস্ত ভুলত্রুটি ও ব্যর্থতার গ্লানি ভুলে নতুনকে বরণ করে নিয়ে সকলের সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনায় উদ্যাপিত হয় নববর্ষ। এসময় ব্যবসায়ীরা নববর্ষের শুরুতে তাদের পুরোনো হিসাব-নিকাশ শেষ করে নতুন হিসাবের খাতা খোলেন। এ উপলক্ষে নতুন-পুরোনো ক্রেতাদের আমন্ত্রণ জানিয়ে ব্যবসায়ীরা মিষ্টিমুখ করান ব্যবসায়ীরা। উৎসবের মধ্য দিয়ে পুরোনো পাওনা আদায় করেন। এছাড়াও লোকে নতুন পোশাক পরে। ঘরে ঘরে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব এবং প্রতিবেশীদের নিমন্ত্রণ করে খাওয়ানো হয়। নববর্ষে উপহারের মাধ্যমে কুশল বিনিময় ও কোলাকুলি করা হয়।

 

নববর্ষ উপলক্ষে বিভিন্ন জায়গায় বসে বৈশাখী মেলা। বিভিন্ন অঞ্চলে নৌকাবাইচ, হাডুডু খেলা, যাত্রা, পালাগান, কবিগান, বাউল-মারফতি-মুর্শিদি-ভাটিয়ালি ইত্যাদি আঞ্চলিক গানের উৎসব হয়।

 

বর্ষবরণ ও চৈত্রসংক্রান্তি উপলক্ষে বাংলাদেশের পার্বত্য এলাকায় বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর বৈসাবি, বিজু ইত্যাদি উৎসব আনন্দমুখর পরিবেশে উদ্যাপিত হয়। ফুলবিজুতে ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীরা জলে ফুল ভাসিয়ে দিয়ে জলদেবতাকে সন্তুষ্ট করে। নববর্ষ উপলক্ষে মারমা ও রাখাইনরা ঐতিহ্যবাহী জলক্রীড়ার আয়োজন করে।

 

'এসো হে বৈশাখ' গানের মধ্য দিয়ে এই দিনে অনেকেই বর্ষবরণের মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করে। একটি বছরের জন্য অশুভকে বিদায় জানায়।

 

  • তোমাদের সময়ে কীভাবে বর্ষবরণ হয় আর দাদু-ঠাকুমার বয়সী লোকেরা শৈশবে কেমন করে বর্ষবরণ করতেন তা নিচের ছকে লেখো। এই কাজটির জন্য তোমরা দাদু-ঠাকুমার বয়সী মানুষদের সাক্ষাৎকার নেবে।

 

বর্ষবরণের একাল-সেকাল

সেকালের বর্ষবরণ, একালের বর্ষবরণ

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

দীপাবলি

 

দীপাবলি কথাটির অর্থ আলোর উৎসব। কার্তিক মাসের অমাবস্যা তিথিতে সারি সারি প্রদীপ জ্বালিয়ে দীপাবলি উৎসব হয়। এই উৎসব দেওয়ালি, দীপান্বিতা, দীপালিকা, দীপালি, সুখরাত্রি ইত্যাদি নামেও পরিচিত। দীপাবলির দিন লক্ষ্মী ও অলক্ষ্মী পূজা করা হয়। অলক্ষ্মীকে বিদায় জানিয়ে লক্ষ্মীকে মহাসমারোহে ঘরে স্থাপন করা হয়। দীপাবলি উপলক্ষে বাড়িঘর পরিষ্কার করা হয়। রঙিন আলপনা এবং বিভিন্ন সামগ্রীতে ঘর সাজানো হয়। হিন্দুধর্মাবলম্বী নতুন জামা-কাপড় পরে। হিন্দুধর্মাবলম্বী ছাড়াও জৈন ও শিখ ধর্মাবলম্বীরা এই উৎসব উদযাপন করেন।

 

শ্রীরামচন্দ্র ১৪ বছরের বনবাস শেষে দেশে ফেরার সময়ে তাঁর ভক্তরা প্রদীপ জ্বালিয়ে উৎসব পালন করেছিলেন। আবার রাম-রাবণের যুদ্ধে রামের জয়ের সংবাদেও অযোধ্যায় দীপাবলি উৎসব উদ্যাপন করা হয়েছিল।

 

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এদিন নরকাসুরকে বধ করে ১৬ হাজার বন্দিনীকে মুক্ত করেন। সেদিন দ্বারকা জুড়ে আলোকমালায় দীপান্বিতা উৎসব উদ্যাপন করা হয়। শ্রীমদ্ভাগবত- এর বর্ণনা অনুসারে বৃন্দাবনে ব্রজগোপিনীরা দীপান্বিতা অমাবস্যায় গিরিরাজ গোবর্ধনের পূজা করে বৃন্দাবনকে অসংখ্য দীপমালায় সজ্জিত করেছিলেন।

 

দীপাবলির অনুষ্ঠান অঞ্চলভেদে পাঁচদিনব্যাপী হয়। প্রথমদিন ধনতেরাস। আশ্বিন মাসের কৃষ্ণা ত্রয়োদশীর দিন এই উৎসবের শুরু। ধনতেরাসের দিন ব্যবসায়ীদের অর্থবর্ষের শুরু। এইদিন নতুন বাসন, সোনার গয়না ইত্যাদি কেনার রীতি দেখা যায়। দ্বিতীয় দিন নরকচতুর্দশী বা ভূতচতুর্দশীতে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য ১৪ রকমের শাক খাওয়া হয়। সাধারণত বাড়ির নারীদের সঙ্গে শিশুরাও নানারকমের শাক সংগ্রহ করতে যায়। এতে তাদের প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় পরিচয় হয়। এই দিন পিতৃ ও মাতৃকুলের চৌদ্দপুরুষকে স্মরণ করে চৌদ্দটা প্রদীপ জ্বালানো হয়। তৃতীয় দিন প্রদীপ, মোমবাতি, আতশবাজিতে মুখরিত হয় দীপাবলি। চতুর্থ দিন শুদ্ধ পদ্যমী বা বালি প্রতিপদা অনুষ্ঠান হয়। এই দিন নববিবাহিত বধূ স্বামীর কপালে মৃত্যুঞ্জয়ী লাল তিলক পরিয়ে আরতির মাধ্যমে তার দীর্ঘায়ু কামনা করে থাকে। বৈষ্ণবরা এইদিন গোবর্ধন পূজা বা অন্নকূট করে ১০৮টি পদ রান্না করে ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে অর্পণ করেন। পঞ্চম দিন উদ্‌যাপিত হয় ভাইফোঁটা বা যমদ্বিতীয়া।

 

ভ্রাতৃদ্বিতীয়া বা ভাইফোঁটা

 

ভ্রাতৃদ্বিতীয়া বা ভাইফোঁটা উৎসব কার্তিক মাসের শুক্লাদ্বিতীয়া তিথিতে কালীপূজার দুই দিন পরে হয়। পুরাণ অনুযায়ী মৃত্যুর দেবতা যম এই তিথিতে বোন যমুনার নিমন্ত্রণে তাঁর বাড়িতে যান। সেই দিন যমুনাদেবী ভাইয়ের কল্যাণ কামনায় পূজা করেন। এই পূজার ফলে যমদেব অমরত্ব লাভ করেন। যম সেদিন যমুনাকে বলেন, এই তিথিতে যে ভাই নিজের বোনের বাড়িতে গিয়ে তাঁর পূজা স্বীকার করবে ও তাঁর হাতে খাবার গ্রহণ করবে, তাঁর ভাগ্যে অকালমৃত্যুর ভয় থাকবে না। সেই থেকে এই তিথিটি যমদ্বিতীয়া, ভ্রাতৃদ্বিতীয়া বা ভাইফোঁটা নামে পরিচিত।

 

 

 

আরেকটি পৌরাণিক কাহিনিতে আছে, নরকাসুরকে বধ করার পর শ্রীকৃষ্ণ বোন সুভদ্রার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। সুভদ্রা ভাইকে মিষ্টি এবং ফুল দিয়ে অভ্যর্থনা করেছিলেন। ভাইয়ের কপালে তিলক লাগিয়েছিলেন। কেউ এই ঘটনাকেও ভ্রাতৃদ্বিতীয়া উৎসবের সূচনা বলে মনে করো।

 

হিন্দুধর্মাবলম্বী অনেকেই এই উৎসব উদ্‌যাপন করেন। উৎসব উপলক্ষে বোন ভাইকে নতুন জামা কাপড় বা অন্যান্য উপহার সামগ্রী দেয় এবং ভাইও বোনকে প্রত্যুপহার দেয়। বাড়িতে বাড়িতে এই দিনে বিশেষ খাবারের আয়োজন করা হয়।

ভাইফোঁটার দিন বোনেরা ভাইয়ের দীর্ঘায়ু কামনা করে ভাইদের কপালে চন্দনের ফোঁটা দিতে দিতে বলে-

ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা, যমের দুয়ারে পড়ল কাঁটা। 

যমুনা দেয় যমকে ফোঁটা, আমি দিই আমার ভাইকে ফোঁটা।

 

রাখিবন্ধন

 

রাখিবন্ধন উৎসবে বোন ভাইয়ের হাতের কবজিতে রাখি বেঁধে দেয়। এর বদলে ভাই বোনকে উপহার দেয় এবং সারা জীবন তাকে রক্ষা করার শপথ নেয়। এরপর ভাই-বোন পরস্পরকে মিষ্টি খাওয়ায়।

যুদ্ধে শ্রীকৃষ্ণের কবজিতে আঘাত লেগে রক্তপাত শুরু হলে দ্রৌপদী নিজের শাড়ির আঁচল ছিঁড়ে শ্রীকৃষ্ণের হাতে বেঁধে দেন। কৃষ্ণ দ্রৌপদীকে নিজের বোন বলে সম্বোধন করতেন এবং দ্রৌপদীকে এর প্রতিদান দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন। অনেকদিন পর কৌরবরা যখন দ্রৌপদীকে অপমান করে তাঁর বস্ত্রহরণ করতে চাইল, তখন শ্রীকৃষ্ণ দ্রৌপদীর সম্মান রক্ষা করে সেই প্রতিদান দেন। এভাবেই রাখিবন্ধনের প্রচলন শুরু হয়। আবার পৌরাণিক কাহিনি মতে, বিষ্ণু বৈকুন্ঠ ছেড়ে দৈত্যরাজ বলির রাজ্য রক্ষা করতে এসেছিলেন। বিষ্ণুর স্ত্রী লক্ষ্মী স্বামীকে ফিরে পাওয়ার জন্য এক সাধারণ মেয়ের ছদ্মবেশে বলিরাজের কাছে আসেন। লক্ষ্মী বলিকে বলেন, আমার স্বামী নিরুদ্দেশ। যতদিন না তিনি ফিরে আসেন, ততদিন আমাকে আশ্রয় দিন। বলিরাজ তাঁর অনুরোধ রাখেন। শ্রাবণ পূর্ণিমা উৎসবে লক্ষ্মী বলিরাজার হাতে একটি রাখি বেঁধে দেন এবং আত্মপরিচয় দিয়ে সব কথা খুলে বলেন। এতে বলিরাজ মুগ্ধ হয়ে বিষ্ণুকে বৈকুন্ঠে ফিরে যেতে অনুরোধ করেন। বলিরাজ বিষ্ণু ও লক্ষ্মীর জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করেন। সেই থেকে শ্রাবণ পূর্ণিমা তিথিটি বোনেরা রাখিবন্ধন উৎসব হিসেবে উদ্যাপন করে।

 

বঙ্গভঙ্গ প্রতিবাদ খ্রীষ্টাব্দে, ১৯০৫ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রাখিবন্ধন উৎসব উদ্‌যাপন করেছিলেন। তিনি বাংলার সকল ধর্মের মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ জাগিয়ে তোলা এবং বাংলাকে ভাগ করার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য এই উৎসব করেন। সেই দিন তিনি পথে পথে হেঁটে সকলের হাতে রাখি পরিয়ে দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ এই দিনটির উদ্দেশ্যে একটি গান লিখেছিলেন-

 

"বাংলার মাটি বাংলার জল বাংলার বায়ু বাংলার ফল- 

পুণ্য হউক, পুণ্য হউক, পুণ্য হউক হে ভগবান। 

বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ- 

পূর্ণ হউক, পূর্ণ হউক, পূর্ণ হউক হে ভগবান। 

বাঙালির পণ, বাঙালির আশা, বাঙালির কাজ, বাঙালির ভাষা- 

সত্য হউক, সত্য হউক, সত্য হউক হে ভগবান। 

বাঙালির প্রাণ, বাঙালির মন, বাঙালির ঘরে যত ভাই বোন- 

এক হউক, এক হউক, এক হউক হে ভগবান।

 

রবীন্দ্রনাথ হয়তো উত্তর ভারত থেকে রাখিবন্ধনের প্রেরণা পেয়েছিলেন। শ্রাবণী পূর্ণিমায় সেখানে হিন্দু ও জৈনসমাজে সৌহার্দ্য বা ভ্রাতৃত্ব রক্ষার উদ্দেশ্যে পরস্পরের হাতে রঙিন সুতা বেঁধে দেওয়ার রীতি আছে। সুতা বাঁধার সময়ে তারা বলে: যার দ্বারা মহাবলী দৈত্যরাজ বলিকে বাঁধা হয়েছিল, তার দ্বারা আমি তোমাকে বাঁধলাম অর্থাৎ এ বন্ধন যেন কখনো ছিন্ন না হয়।

 

দলে/জোড়ায় পরিকল্পনা করে সহজলভ্য উপাদান দিয়ে নান্দনিক রাখি তৈরি করে সহপাঠীদের সঙ্গে 'রাখিবন্ধন' উৎসব উদ্যাপন করো।

রাখিবন্ধন উৎসবের আলোকে নিচের ছকটি পূরণ করো।

 

ছক ২.৭: রাখিবন্ধনের গুরুত্ব

রাখিবন্ধন উৎসব থেকে তুমি যে মূল্যবোধ অর্জন করেছ

ডান দিকের ঘরে গোল চিহ্ন দাওশিষ্টাচার, ধর্মনিষ্ঠতা, ন্যায়পরায়ণতা, ভ্রাতৃপ্রেম, পিতা-মাতার প্রতি ভক্তি, সত্যবাদিতা, গুরুজনে ভক্তি, মানবিকতা, সহমর্মিতা, দায়িত্বশীলতা, অধ্যবসায়, সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি, পরমতসহিষ্ণুতা,
  

রাখিবন্ধন উৎসব থেকে অর্জিত মূল্যবোধকে তুমি কীভাবে মানুষের কল্যাণে কাজে লাগাবে?

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

নবান্ন

 

'নবান্ন' শব্দের অর্থ 'নতুন অন্ন' বা নতুন ভাত। এটি বাংলার একটি লোকজ উৎসব। হেমন্তে আমন ধান কাটার পর অগ্রহায়ণ কিংবা মাঘ মাসে হিন্দুগৃহস্থরা এই উৎসব উদ্যাপন করে। নবান্ন উৎসবে দেবতা, অগ্নি, ব্রাহ্মণ, পাড়া-পড়শি, আত্মীয়-স্বজনকে নতুন অন্ন নিবেদন করা হয়। এই উৎসবে চালের তৈরি খাদ্যসামগ্রী কাককে নিবেদন করা একটি বিশেষ লৌকিক প্রথা। তন্ত্রশাস্ত্র অনুযায়ী, কাকের মাধ্যমে ওই খাদ্য মৃতের আত্মার কাছে পৌঁছে যায়। এই নৈবেদ্যকে বলে 'কাকবলী'।

পৌষসংক্রান্তির দিনেও গৃহদেবতাকে নবান্ন নিবেদন করার প্রথা আছে। এই দিন নতুন ধানের চাল দিয়ে ভাত, নানা রকম পিঠা দিয়ে পূর্বপুরুষদের শ্রাদ্ধ করা হয়। কালের বিবর্তনে এই নবান্ন উৎসবের মুখরতা অনেকটা কমে গেলেও গ্রামবাংলায় এখনো টিকে আছে। নবান্ন উৎসবে পিঠা-পায়েস আদান প্রদান কীর্তন, পালাগান, জারিগানে গ্রামবাংলা মুখরিত হয়ে ওঠে।

 

গৃহপ্রবেশ

 

নতুন বাড়ি তৈরি এবং বাড়িতে প্রথম প্রবেশ করার সময় বিভিন্ন পূজা ও মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানের বিধান আছে। আমাদের জীবনে চতুবর্গ ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষকে পরিপূর্ণতা দেয় একটি গৃহ। নতুন গৃহে প্রবেশের সময় বিষ্ণু, বাস্তু বা ভূমি, গৃহকর্তার অভীষ্ট দেবতার পূজা করা হয়। এ সময় নান্দিমুখ বৃদ্ধিশ্রাদ্ধের মাধ্যমে পূর্বপুরুষদের আশীর্বাদ কামনা করা হয়। দ্বারদেবতার পূজা হয়। নতুন ঘর তৈরির আগে ভূমি পূজা বা ভিত পূজারও বিধান আছে। গৃহপ্রবেশের দিন পুরোহিত, গুরুজন, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশী সবাইকে নিমন্ত্রণ করে খাওয়ানো হয়। এই দিন গৃহকর্তা সকলকে নিয়ে গৃহের সর্বাঙ্গীণ সুখ, শান্তি, সমৃদ্ধির মঙ্গলের জন্য প্রার্থনা করেন।

 

তোমার এলাকায় হিন্দুধর্মসংশ্লিষ্ট যেসব লোক উৎসব উদ্যাপিত হয় সেগুলো সম্পর্কে দলে বা জোড়ায় তথ্য সংগ্রহ করো। এরপর নিচের ছকটি এককভাবে পূরণ করো।

 

ছক ২.৮: আমার এলাকার লোক উৎসব

লোক উৎসবের নাম

উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যসমূহ

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

জন্ম ও জন্ম পরবর্তী ক্রিয়া বা দশবিধ সংস্কার

 

ধর্মীয় রীতি-নীতি ও ঐতিহ্য অনুসরণ করে সমগ্রজীবনে যেসব মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান পালন করা হয়, সেগুলোই হিন্দুধর্মমতে সংস্কার। মনুসংহিতা, পরাশরসংহিতা, যাজ্ঞবন্ধ্যসংহিতা প্রভৃতি স্মৃতিশাস্ত্রে হিন্দুধর্মের এসব সংস্কারগুলো পূর্ণাঙ্গরূপে লেখা আছে।

 

জন্ম ও জন্ম পরবর্তী সময়ে প্রত্যেক সনাতন ধর্মাবলম্বীর জন্য পালনীয় কিছু বিধি-বিধান আছে। এগুলোকে দশবিধ সংস্কার বলা হয়। এসবের মধ্যে রয়েছে-গর্ভাধান, পুংসবন, সীমন্তোন্নয়ন, জাতকর্ম, নামকরণ, অন্নপ্রাশন: বিদ্যারম্ভ, চূড়াকরণ, উপনয়ন, সমাবর্তন বিবাহ। বৈদিক যুগে এ সকল সংস্কার পালিত হলেও এখনকার সময়ে দশবিধ সংস্কারের সবগুলো সমানভাবে পালিত হয় না। এখন যে সকল সংস্কার পালিত হয় তাদের মধ্যে অন্যতম কয়েকটি হলো

 

সীমন্তোন্নয়ন: গর্ভধারণের পর চতুর্থ, ষষ্ঠ বা অষ্টম মাসে নিরাপদ প্রসবের আকাঙ্ক্ষায় এই সংস্কার পালন করা হয়। বর্তমানে এই সংস্কার সাধ-ভক্ষণ বা সাধ নামে বেশি পরিচিত। 

জাতকর্ম: সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পিতা যব, যষ্টিমধু ও ঘৃত দ্বারা সন্তানের জিহ্বা স্পর্শ করে মন্ত্রোচ্চারণ করেন।

নামকরণ: সন্তান ভূমিষ্ঠ হবার দশম, একাদশ, দ্বাদশ বা শততম দিনে নামকরণ করতে হয়। 

নিষ্ক্রমণ: নিষ্ক্রমণ অর্থ 'বাইরে যাওয়া'। এই অনুষ্ঠানে বাবা-মা শিশুকে বাইরে নিয়ে যান। এ সময়ে শিশুটি প্রথমবারের মতো বাইরের পরিবেশের সঙ্গে পরিচিত হয়। জন্মের পর চতুর্থ মাসে এটি পালন করার নিয়ম। শিশুকে স্নান করিয়ে নতুন পোশাক পরানো হয়। তাকে বাইরে নিয়ে সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত, চাঁদ বা সূর্য দেখানো হয়। 

অন্নপ্রাশন: শিশুর প্রথম খাবার খাওয়া উপলক্ষে যে মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান হয়, তাকে অন্নপ্রাশন বলে। একে আমরা 'মুখে ভাত' হিসেবেও জানি। পুত্র সন্তানের ক্ষেত্রে যষ্ঠ বা অষ্টম মাসে এবং কন্যা সন্তানের ক্ষেত্রে পঞ্চম বা সপ্তম মাসে এই অনুষ্ঠান হয়। অন্নপ্রাশনে আত্মীয়, প্রতিবেশীরা নিমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে এসে শিশুকে আশীর্বাদ করেন, উপহার দেন।

 

অন্নপ্রাশনের পর বিদ্যারম্ভ নামে আরেকটি সংস্কার প্রচলিত আছে।

 

বিদ্যারম্ভ: ছোট শিশুদের জ্ঞান, অক্ষর এবং শেখার প্রক্রিয়ার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার অনুষ্ঠান। শিশু চার বছর অতিক্রম করলে পঞ্জিকা দেখে বিদ্যারম্ভের উপযুক্ত সময় নির্ধারণ করা হয়। এরপর পূজা-অর্চনা হয়। শিশুকে হাতে ধরে অক্ষর লেখানো হয়। এই সংস্কার 'হাতেখড়ি' নামেই বেশি পরিচিত। সাধারণত সরস্বতী পূজার সময় শিশুদের হাতেখড়ি অনুষ্ঠান করা হয়।

চূড়াকরণ: গর্ভাবস্থায় সন্তানের মাথায় যে চুল হয়, কেটে ফেলার তা মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান। উপনয়ন সংস্কার থাকলে এটি উপনয়নের সময় নতুবা অন্নপ্রাশনের সময়ে সম্পন্ন করা হয়।

 

এই সংস্কারের সঙ্গে কর্ণভেদ নামে একটি অতিরিক্ত সংস্কারের উল্লেখ আছে।

 

 

কর্ণভেদ: কর্ণভেদ অর্থ 'কানে ছিদ্র করা'। এই সংস্কার মেয়ে শিশুদের ক্ষেত্রে বেশি পালন করতে দেখা যায়। 'উপনয়ন' সংস্কারে চূড়াকরণের পর কর্ণভেদের বিধান আছে। 

উপনয়ন: উপনয়ণ সংস্কারে বিদ্যাশিক্ষার জন্য শিক্ষার্থীকে প্রথমে গুরুর কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। 'উপনয়' শব্দটির মানে 'কাছে নিয়ে যাওয়া'। প্রচলিত একটি অর্থে উপনয়ন বলতে বোঝায় যজ্ঞোপবীত বা পৈতা ধারণ। 

সমাবর্তন: লেখাপড়া শেষে গুরু যখন শিষ্যকে বাড়ি ফেরার অনুমতি দেন তখন একটি উৎসব হয়। এটিই সমাবর্তন। আগেকার দিনে উপনয়ন শেষে গুরুগৃহে বাস করাই ছিল রীতি। সেখানে লেখাপড়া শেষ করে গুরুর অনুমতি নিয়ে বাড়ি ফিরতে হতো।

 

বর্তমানে গুরুগৃহে থেকে বিদ্যাশিক্ষার প্রচলন নেই। সে কারণে এ সংস্কারটি এখন আর পালিত হয় না, তবে 'সমাবর্তন' নামটি আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদপত্র বিতরণ উৎসব এখন 'সমাবর্তন' নামে উদ্যাপিত হয়। এখনকার সময়ে যারা স্নাতক বা স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়, তাদের উপাধিপত্র (সার্টিফিকেট) প্রদান উৎসবের সঙ্গে আগেকার গুরুগৃহ ত্যাগের উৎসবের তুলনা করা যেতে পারে।

বিবাহ: বিবাহ শব্দের অর্থ বিশেষরূপে ভার বহন করা। প্রাপ্তবয়সে বেদ ও পিতৃপুজা, হোম ইত্যাদির মাধ্যমে মন্ত্র উচ্চারণ করে একজন ছেলে ও একজন মেয়ের জীবনকে একসঙ্গে মিলিয়ে দেওয়ার সংস্কারকে বিবাহ বা বিয়ে বলা হয়। এর মাধ্যমে পরিবার গড়ে ওঠে। পরিবারের সকলে মিলেমিশে সুখ-দুঃখ ভাগ করে, একে অপরকে সহযোগিতা করে জীবন যাপন করে।

 

বিবাহে যেমন কতকগুলো শাস্ত্রীয় বিধি-বিধান পালিত হয়, তেমনি পালিত হয় কতকগুলো লৌকিক ও স্থানীয় আচার।

 

মনুসংহিতায় বিভিন্ন রকমের বিবাহ পদ্ধতির বর্ণনা আছে। এর মধ্যে ব্রাহ্ম, দৈব, আর্য, প্রাজাপত্য উল্লেখযোগ্য। বর্তমান সমাজে ব্রাহ্ম বিবাহই বেশি প্রচলিত ও স্বীকৃত। বাবা-মা মেয়েকে নতুন কাপড় ও অলংকারে সাজিয়ে, আমন্ত্রিত অতিথি ও আত্মীয় স্বজনকে সাক্ষী রেখে, বরের কাছে কন্যাদান করেন। একে ব্রাহ্মবিবাহ বলে। আবার প্রাচীনকাল থেকে আধুনিককাল পর্যন্ত সমাজে গান্ধর্ব বিবাহেরও প্রচলন আছে। নারী-পুরুষ পরস্পরের প্রতি শপথ করে মাল্য বিনিময়ের মাধ্যমে যে বিবাহ করে, তাকে বলা হয় গান্ধর্ব বিবাহ। বিবাহের সর্বশ্রেষ্ঠ মন্ত্রটি হলো-

 

"যদিদং হৃদয়ং তব তদন্ত হৃদয়ং মম। যদিদং হৃদয়ং মম, তদন্ত হৃদয়ং তব।" (ছান্দোগ্য ব্রাহ্মণ) 

অর্থাৎ তোমার এই হৃদয় হোক আমার, আমার হৃদয় হোক তোমার।

বিবাহের মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে গভীর প্রীতিপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠবে বলে প্রত্যাশা থাকে। তারা একে অপরের সুখ-দুঃখের সাথি হয়ে জীবনের পথে নতুন যাত্রা শুরু করে।

 

  • পরিবারের বড়দের সঙ্গে/অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনা করে দশবিধ সংস্কারের মধ্যে কোনগুলো এখনকার দিনে পালিত হয় আর কোনগুলো হয় না, তার তালিকা তৈরি করো।

 

ছক ২.৯: সংস্কারের একাল-সেকাল

বেশিরভাগ মানুষ এখনও পালন করে

খুব কম পালিত হয়

এখন আর পালিত হয় না

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

আমাদের সংগৃহীত উপকরণ

বন্ধুদের সংগৃহীত উপকরণ

উৎসবের নাম

উপকরণ

উৎসবের নাম

উপকরণ

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

Content added || updated By
Promotion